ঢাকা, বাংলাদেশ ২৩ মে, ২০২৫

লেখকের দায়বদ্ধতা

লেখকের দায়বদ্ধতা

কাজী খাদিজা আক্তার

Publish : 12:16 AM, 12 December 2024.
কাজী খাদিজা আক্তার :

লেখক একটি বিস্তৃত অর্থে ব্যবহৃত হয়, এবং এতে সুরকার, শিল্পী, ভাস্কর এবং এমনকি স্থপতিও অন্তর্ভুক্ত থাকেন। চিত্রশিল্পী একজন লেখক তার চিত্রের মাধ্যমে, গীতিকার তিনিও লেখক। তবে শুধু লেখক বলতে আমরা বুঝি সাধারণত যিনি লিখিত ভাষা সৃষ্টি করেন তাকে। আর সেই লেখক হচ্ছেন জাতির বিবেক। তাহলে জাতির বা রাষ্ট্রের বিবেককে জাগ্রত করার দায়ভার কিছু স্বাভাবিকভাবে লেখকের ওপরও বর্তায়- যদি তিনি তার বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। তাই বলা যায়, লেখকের দায়িত্ব নির্ধারিত নয় কিংবা তিনি লেখার জন্য কারোর কাছে বাধ্য নন, বড়জোড় তার সৃষ্টির জন্য তিনি জনগণ বা পাঠক দ্বারা আলোচিত বা সমালোচিত হতে পারেন। লেখক সেলিনা হোসেন বলেছেন, যে মানবিক মূল্যবোধের কথা লিখিত দলিলে উচ্চারণের কারণে লেখকের দায়িত্ব বিবেচিত হয় বিশেষ যুগে, বিশেষ সমাজব্যবস্থায় তার সংজ্ঞা বারবার পাল্টায়। তাই লেখকের দায়িত্ব কথাটি আপেক্ষিক এবং আজ পর্যন্ত কেউ লেখকের দায়িত্ব নির্ধারণ করে দিতে পারেননি।

দায়িত্ব নির্ধারিত নয় তবে বিবেকবান সৃষ্টিশীল লেখক দায়িত্ব বোধ করলে তা এড়িয়ে যাওয়াটাও তার কাছে দায়িত্বহীনতা মনে হয়। একজন সৃষ্টিশীল লেখকের দায়ভার থাকে কারণ, সে তার মেধা, সততা, স্বচ্ছতা, কল্পনা বিবেক দিয়ে শব্দের যে গাঁথুনি তৈরি করেন তা তার অন্তর থেকে লাখো-কোটি অন্তরে গিয়ে বসত করে। সাধারণের হৃদয়কে শানিত করবার সে সুযোগ কেবল অথর্বরাই হাতছাড়া করেন। যে লেখক ইতিহাসের দলিলে তার নাম লিখতে চান কোনো এক শতাব্দী, যুগ বা কালের সাক্ষী হয়ে সে লেখক সময়ের দাপটে নুইয়ে পড়েন না কারোর রক্তচক্ষুকে ভয় করেন না। 

রুশ সাহিত্যিক সোলজেনিৎসিন যিনি নিজে সরকারের সমালোচনা করার জন্য নির্বাসিত হয়েছেন, নিজের দেশ থেকে বিশ বছর দূরে থেকেছেন; যার বই বহু বছর নিষিদ্ধ ছিলো, তিনি লেখককে বলেছেন স্বদেশের দ্বিতীয় সরকার। অবশ্য এবাক্য বা ধারণা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে খুবই অযৌক্তিক এবং অসার একটি বাক্য। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে লেখকদের যে বিষয়ের সম্মুখীন হতে হয় তা হচ্ছে রাজনৈতিক চাপ এবং অপমান। তাদের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়াটা তাদের মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করে। লেখকের লেখার স্বাধীনতা নিশ্চিত করাটা জরুরি হয়ে পরে লেখকের দায়বদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। লেখককে তার নিজের বিবেকের কাছেও দায়বদ্ধ থাকা সৎ থাকা শুধু প্রয়োজনই নয় জরুরিও বটে। 

আহমদ ছফা তার 'একাত্তর : মহাসিন্ধুর কল্লোল' প্রবন্ধে লিখেন, গোটা দেশের রাজনীতিতে একটা উত্তাল তরঙ্গ ফুঁসে ফুঁসে উঠছিল। মওলানা ভাসানীর জ্বালাও- পোড়াও-ঘেরাও আন্দোলন খান সাহেবের সামরিক শাসনের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে।তারপর আগরতলা ষড়যন্ত্র  মামলা শুরু হয়েছে। ছাত্রদের ক্রমাগত আন্দোলন চলছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বত্র একটা থমথমে অবস্থা- প্রলয় ঝড়ের পূর্বে প্রকৃতি যেমন। এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের লেখক-সাহিত্যিকরা যে ভূমিকা পালন করে আসছিলেন, সেটাকে কিছুতেই গৌরবজনক বলা যাবে না।

তাহলে কি কিছুটা ফাঁক ছিলো কিংবা অসম্পূর্ণ অংশগ্রহণ। যুগে যুগে আমরা যখন এমন অস্তিত্বের লড়াইয়ের সম্মুখীন হই তখন কেন যেন মনের ভেতর আগুনের লেলিহান শিখাকে আরো ভয়ংকরভাবে প্রতিবাদী করে তুলতে সম্মুখ সমরে কলম যোদ্ধাদের অনেক বেশি যোগানদাতা মনে হয়। সেই সময়ে তাদের একটি প্রতিবাদী লাইন, একটি কলাম, একটি কবিতা, একটি গান, একটি ভাষণ, একটি শব্দ, কোটি কোটি জনতার স্লোগান সাহস আর শব্দাস্র হয়ে যায়। রক্তে তরঙ্গের সঞ্চার করে, পুরো জাতির মস্তিষ্কে মননে বুঁদ হয়ে থাকে 'স্বাধীনতা' শব্দটি। আহমদ ছফা তার লিখায় কিছুটা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তার সেই অসন্তুষ্টি আরো স্পষ্ট হয় এই লাইনগুলোতে, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সর্বত্র মিটিং চলছে। কিন্তু লেখকদের মধ্যে তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এই লেখক-সাহিত্যিকদের অনেকেই ছিলেন আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ এবং শ্রদ্ধেয়। তাদের নিস্ক্রিয়তা দেখে আমরা নিজেরা লজ্জিত হতাম এবং মাঝে মাঝে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতাম।

খুব স্পষ্ট করেই বোঝা যায় যে তখনো কেউ কেউ নিস্ক্রিয় থেকেছেন- তবে সকলে নয়, অনেকেই  কলম নিয়েও লড়েছেন। লেখকের দায়বদ্ধতা নেই, সেকথা বলতে নারাজ আমি, কারণ লেখক তার রাষ্ট্র এবং জনগণের সাথে সম্পৃক্ত। তবে এটাও ঠিক, প্রত্যেক লেখক স্বতন্ত্র, সে যদি মনে করে যে সে সততা বা সত্যের পথে অধিকারের পক্ষে তার কলমকে শানিত করবে তাহলে সেটা যেমন তার নিজস্ব ইচ্ছা তেমনি সে যদি ভাবে জাতি বা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে বা ক্রান্তিলগ্নে সে নিস্ক্রিয় থাকবে তাহলে সেটাও তার অভিরুচি। 

লেখকের এই দায়ভার তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়াটাও একটা সংকীর্ণতা। আর যারা এই সংকীর্ণতার বসে আসতে পারেননি তারাই ইতিহাসের পাতায় নক্ষত্র আর ধুমকেতু। তেমনি ছিলেন আমাদের নজরুল। ১৯২২ সালে নজরুলের প্রচ্ছন্ন  রাজনৈতিক কবিতা `আনন্দময়ীর আগমনে‘ প্রকাশিত হলে সেটি নিষিদ্ধ হয় এবং তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করে  এক বছরের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাকে ব্রিটিশ সরকারের রাজদ্রোহিতার অপরাধে কারাবন্দী করা হয়। নজরুলের বিদ্রোহী চেতনা কোনো যুগ বা কালের মধ্যে আটকে থাকে না আর সেজন্যই তার সৃষ্টি সকল কালের সকল দেশের এবং প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে তা চির প্রাসঙ্গিক।

ফরাসি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক, নাট্যকার, সাহিত্যিক, সমালোচক জাঁ পল সার্ত্র আলজেরিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। তার এই ভূমিকা বিশ্বব্যাপী জনমত গঠনে সহায়তা করে এবং দ্য গল সরকার বাধ্য হন আলজেরিয়ার স্বাধীনতা দিতে। তেমনি ইতিহাসের আরেক নক্ষত্র বার্ট্রান্ড রাসেল ভিয়েতনাম যুদ্ধের সপক্ষে ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইবুনাল গঠন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ স্বদেশের সংকটে, দুঃসময়ে, দুর্যোগে সবমসময় ছিলেন সোচ্চার। ফ্যাসিস্ট শক্তির প্রতির ছিলো তার তীব্র ঘৃণা আর প্রতিবাদ। হিটলারের নাৎসিবাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন। ফরাসি কবি, সাংবাদিক এবং ঔপন্যাসিক আনাতোল ফ্রঁস, ম্যাক্সিম গোর্কি সম্পর্কে বলেছিলেন, গোর্কি শুধু রাশিয়ার নন, গোর্কি সমগ্র পৃথিবীর।

কেন বলেছিলেন? কারণ তার সৃষ্টি কোনো নির্দিষ্ট জনপদ বা রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না। তাই লেখক তার দায়বদ্ধতা থেকে এড়িয়ে চললে, বিবেক বিসর্জন করলে মহাকাল তাকেও সময়ের সাথে সাথে কালের গহবরে বিসর্জন করতে ভুল করে না।

বাংলাদেশের লেখকরাও এই প্রতিবাদের দায়ভার কোনো কালেই এড়িয়ে যাওয়ার মতো ঘৃণ্য হননি। আগেই বলেছি নজরুলের কথা। এ ছাড়া ইতিহাসে বার বার প্রমাণিত হয়েছে বলিষ্ঠ লেখক, বুদ্ধিজীবীদের অবদানের কথা। পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে প্রতিবাদ করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেছিলেন, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে পূর্ববঙ্গের ছাত্রদের ওপর বাংলা ভাষা ব্যতীত যদি অন্য কোনো ভাষা আরোপ করা হয় তবে ইহার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো আমাদের উচিত। এমনকি প্রয়োজন হইলে ইহার বিরুদ্ধে আমাদের বিদ্রোহ করা উচিৎ।

আহমদ ছফা রচিত `একাত্তর : মহাসিন্ধুর কল্লোল‘-এ উল্লেখ আছে, একাত্তরের কিছু পূর্বের, একাত্তর এবং একাত্তরের পরের কিছু সময়ের লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের কর্মকাণ্ডের চিত্র। সে সময়ে ছোট ছোট সাহিত্য সভার আয়োজন করা, সিনিয়র জুনিয়রদের মধ্যে সাহিত্য আর দেশ নিয়ে আলোচনা করা, আইয়ুব খানের লেখক সাহিত্যিকদের নিয়ে বাণিজ্য করার জন্য পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ড প্রতিষ্ঠান গঠন, আহমদ ছফার `লেখক সংগ্রাম শিবির‘ নামকরণ করা, 'ভবিষ্যতের বাংলা' শিরোনামে সেমিনার ইত্যাদি বিষয়গুলো বুঝিয়ে দেয়-  সেসময়কার লেখক সমাজের দায়বদ্ধতা কেমন ছিলো। যে যার মতো করে এগিয়ে এসেছেন আবার কেউ কেউ সুবিধা করেও চলেছেন। আমাদের নিজেদের লেখকদের দায়বদ্ধতা বলেন আর দায়িত্ব বলেন সেটা দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে প্রকট ছিলো বলেই ২৫ মার্চ স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান বাহিনী গণহত্যার সাথে সাথে হত্যা করেছিলো এদেশের সূর্য সন্তান লেখক-বুদ্ধিজীবীদের। একইভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয় একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর। কারণ শত্রুরা ভয় পেয়েছিলো লেখক বুদ্ধিজীবীদের মেধা, মনন, বিবেক আর সৃজনশীলতাকে।

লেখক তার নিজের ভালোলাগার তৃষ্ণা থেকে যেমন নিজের জন্য লিখেন তেমনি সময়ের দাবী থেকে সকল জাত, দেশ ও কালের জন্যও কলম তুলে নেন বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতা থেকে। আর সেজন্যই সত্যের পথে সততার সঙ্গে থেকে কালে কালে বহু লেখক কারাবরণ করেছেন, নিগৃহীত হয়েছেন, নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন এবং অপরাধ না করেও মাথা নত করে ক্ষমা চেয়েছেন তার নিজের দেশের শাসকগোষ্ঠীর কাছে শুধুমাত্র দ্বিমুখী আচরণে পারদর্শী হতে না পারার অপরাধে। 

লেখক : শিক্ষক এবং কলামিস্ট। 

পিপলনিউজ/আরইউ

-- বিজ্ঞাপন --
CONTACT
[email protected]

মতামত বিভাগের অন্যান্য খবর

Follow Us

ভারপ্রাপ্ত প্রকাশক, আরিফুর রহমান কর্তৃক
ডা. নওয়াব আলী টাওয়ার, ২৪ পুরানা পল্টন, ঢাকা থেকে প্রকাশিত।
ফোনঃ +৮৮ ০১৭৩২ ৪১৭ ৫১৭
Email: [email protected]

©২০২৪ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || VOD Bangla.com

Develop by _ DigitalSolutions.Ltd